স্মার্ট মোবাইল ফোনের প্রতিটি ব্লকের বর্ণনা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-স্মার্ট মোবাইল ফোনের প্রতিটি ব্লকের বর্ণনা

স্মার্ট মোবাইল ফোনের প্রতিটি ব্লকের বর্ণনা (Description of Each Block in Smart Mobile Phone System)

অনুচ্ছেদ ৪.১.৪ এ (চিত্র-৪.৪) স্মার্ট মোবাইল ফোনের ব্লক ডায়াগ্রাম অংকন এবং নিম্নে প্রতিটি ব্লকের বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো।

১. প্রসেসর (Processor): স্মার্টফোন প্রসেসসর, যা চিপসেট নামেও পরিচিত। এটি এমন একটি উপাদান যা স্মার্টফোনের সকল কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সঠিকভাবে কাজ করার বিষয়টি নিশ্চিত করে। প্রসেসরকে মানবদেহের মস্তিষ্কের সাথে তুলনা করা যায়। স্মার্টফোনে প্রতিটি ক্রিয়া সরাসরি প্রসেসরে আসে এবং প্রসেসর প্রসেসিং করে বিভিন্ন সেকশনে প্রেরণ করে।

প্রসেসর মূলত সিপিইউ (Central Processing Unit) এবং জিপিইউ (Graphics Processing Unit) ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত হয়। প্রসেসর ইউনিটে এসডি/এমএমসি কন্ট্রোলার (SD/MMC Controller), ইউএসবি (USB), ইনপুট/আউটপুট পোর্ট (I/O Port: Input/Output Port), সিরিয়াল কন্ট্রোলার (Serial Controller), গ্রাফিক্স কন্ট্রোলার (Graphics Controller), মেমোরি এবং লোকাল বাস কন্ট্রোলার (Memory and Local Bus Cotroller), অডিও/ভিডিও ইন্টারফেস কন্ট্রোলার (Audio/Video Interface Controller) এর সকল কার্যকে প্রসেসিং এবং নিয়ন্ত্রণ করে।

প্রসেসর হিসেবে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে সাধারণত কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন ( Qualcomm Snapdragon), মিডিয়াটেক (Media Tek), কিরিন ( Kirin ), এক্সিনোস (Exynos ) ইত্যাদি প্রসেসর ব্যবহার করা হয়। অ্যাপলের আইফোনে অ্যাপল বায়োনিক (Apple Bionic) প্রসেসর ব্যবহার করা হয়।

 

স্মার্ট মোবাইল ফোনের প্রতিটি ব্লকের বর্ণনা

 

২. রম (ROM): রম হলো রিড অনলি মেমোরি (Read Only Memory)। যে স্মৃতিতে (Memory) তথ্য শুধু পড়া (Read) যায় কিন্তু নতুন কোনো তথ্য লেখা (Write) যায় না তাকে রম (ROM) বলে। রমে তথ্য স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ হয়ে থাকে। রম (ROM) কে সাধারণত ফ্লাশ রম (Flash ROM) হিসেবে নামকরণ করা হয়।

স্মার্ট ফোনে ন্যান্ড ফ্লাশ (NAND Flash) এবং নর ফ্লাশ (NOR Flash) রম ব্যবহার করা হয়।

৩. র‍্যাম (RAM): র‍্যাম হলো র‍্যানডম অ্যাকসেস মেমোরি (Random Access Memory)। র‍্যামে যে কোনো নতুন তথ্য লেখা (Write) যায় এবং প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করা যায়। র‍্যামে তথ্য স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ থাকে না। বিদ্যুৎ চলে গেলে র‍্যামের ভিতরে সকল তথ্য মুছে যায় বলে ইহাকে উদ্বায়ী (Volatile) স্মৃতি বলা হয়।

র‍্যাম মোবাইল ফোনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। মোবাইল ফোনের র‍্যাম যত বেশি হবে কার্যক্ষমতা তত বেশি হবে। ইহা এক প্রকার প্রধান স্মৃতি (Primary Memory) হিসেবে মোবাইল সিস্টেমে কাজ করে । মোবাইল ফোনে র‍্যাম (RAM) কে এসডির‍্যাম (SDRAM) হিসেবেও নামকরণ করা হয়।

৪.পাওয়ার ইউনিট (Power Unit): মোবাইল ফোনের সকল ইউনিটে পাওয়ার সরবরাহ করা এবং চার্জিং নিয়ন্ত্রণ করা পাওয়ার ইউনিটের কাজ। পাওয়ার ইউনিটে মূলত একটি ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC-Integrated Circuit) ব্যবহার করা হয়, যাকে পাওয়ার আইসি বলা হয়।

কিছু স্মার্টফোনে পাওয়ার ইউনিট সাধারণত সিপিইউ বা প্রসেসর ইউনিটের সাথে যুক্ত থাকে, যা সরাসরি সিপিইউ হতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। একে মেইন পাওয়ার ইউনিট (MPU) বলা হয়। পাওয়ার কনভার্টার (Power Converter) এর মাধ্যমে পাওয়ারকে প্রয়োজন অনুযায়ী কনভার্ট করে বিভিন্ন সেকশনে প্রেরণ করা হয়।

৫. চার্জিং ইউনিট (Charging Unit) বা ইউএসবি ব্যাটারি চার্জার (USB Battery Charger): চার্জিং ইউনিটে চার্জিং কানেক্টর হিসাবে ইউএসবি টাইপ এ (মাইক্রো ইউএসবি) বা ইউএসবি টাইপ সি ব্যবহার করা হয় এবং চার্জিং নিয়ন্ত্রণের জন্য ফিউজ ও ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ব্যবহার করা হয়। চার্জিং কানেক্টরে চার্জার সংযোগ করে মোবাইল ফোন চার্জ করা হয়।

৬. পাওয়ার অ্যাম্প্লিফায়ার ( Power Aplifier): পাওয়ার অ্যাম্প্লিফায়ারকে সংক্ষিপ্তভাবে পিএ (PA) বলা হয়। পাওয়ার অ্যাম্প্লিফায়ার মূলত পিএ অ্যাম্প্লিফায়ার, যা এক মোবাইল ফোন হতে অন্য মোবাইল ফোনে সিগন্যাল (অডিও, ভিডিও বা ডাটা) প্রেরণ বা গ্রহণ করার সময় অ্যাম্প্লিফায়ার হিসেবে কাজ করে এবং রিসিভার (Rx) ও ট্রান্সমিটার (Tx) সুইচ হিসেবেও কাজ করে।

৭. ব্যাটারি (Battery): ব্যাটারি মোবাইল ফোনের সকল ইউনিটকে কার্যকরী করার জন্য ডিসি (DC-Direct Current) পাওয়ার সরবরাহ করে থাকে। মোবাইল ফোনে সাধারণত ৩.৭ ভোল্টের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি (Lithium Ion Battery) ব্যবহার করা হয়। কিছু ফোনে সময় নিয়ন্ত্রণ বা টাইম ব্যাক-আপের জন্য একটি ব্যাক-আপ (Backup) ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়।

৮. ডিসপ্লে (Display): মোবাইল ফোনের ডিসপ্লে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট বা কম্পোনেন্ট। যার সাহায্যে ডাটা, ছবি বা ভিডিও আমাদের দর্শনযোগ্য করে প্রদর্শন করে। স্মার্টফোনে (Smartphone) সাধারণত আইপিএস(IPS-In-Plane Switching), এইচডি(HD High Definition), ফুল এইচডি, ফুল এইচডি প্লাস, রেটিনা (Retina) ইত্যাদি ডিসপ্লে ব্যবহার করা হয়।

 

স্মার্ট মোবাইল ফোনের প্রতিটি ব্লকের বর্ণনা

 

ডিসপ্লেকে আলোকিত করার জন্য এবং ডিসপ্লে ব্রাইটনেস নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাকলাইট (Backlight) ব্যবহার করা হয়। ব্যাকলাইটকে কার্যকারিতা করার জন্য ব্যাকলাইট সাপ্লাই (Backlight Supply) হতে পাওয়ার সরবরাহ করা হয়। স্মার্টফোনে সাধারণত এলসিডি ডিসপ্লে এর উপরে ক্যাপাসিটিভ টাচ স্ক্রিন ব্যবহার করা। টাচ স্ক্রিনের মাধ্যমে ফোনের অ্যাপ্লিকেশন সফ্টওয়্যার ও বিভিন্ন ফাংশন খুব দ্রুত এবং সহজে ব্যবহার করা যায়।

৯.ক্যামেরা (Camera ): মোবাইল ফোনে ছবি তোলা বা ভিডিও ধারণের জন্য ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। স্মার্ট ফোনে বিভিন্ন মেগাপিক্সেলের (Mega Pixel Camera) একাধিক ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। ব্যাক সাইডে সাধারণত ওয়াইড (Wide), আলট্রাওয়াইড (Ultrawide), ম্যাক্রো (Macro), ডেপথ সেন্সর (Depth Sensor) বা টেলিফটো লেন্স (Telephoto Lens) ব্যবহার করা। ফ্রন্ট সাইডে এক বা একাধিক ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়, যা ফ্রন্ট ক্যামেরা নামে পরিচিত করা হয়।

১০. টাচ কিপ্যাড (Touch Keypad ): স্মার্টফোনে সাধারণত টাচ কিপ্যাড ব্যবহার করা হয়। টাচ কিপ্যাডের মাধ্যমে ফিজিক্যালি কিপ্যাডের মতো নাম্বার এবং টেক্সট টাইপ করা যায়। এতে দ্রুত টাইপ করা যায় এবং কিপ্যাডের ল্যাংগুয়েজ বা ভাষা পরিবর্তন করা যায়।

১১. মেমোরি ইউনিট (Memory Unit): মোবাইল ফোনে অডিও বা ভিডিও পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত এসডি কার্ড (মেমোরি কার্ড) সংযুক্ত করার জন্য মেমোরি সকেট ব্যবহার করা হয়। মেমোরি সকেটে মেমোরি সংযুক্ত করে সিপিইউ বা প্রসেসরের এসডি/ এমএমসি কন্ট্রোলারের মাধ্যমে মেমোরি ইউনিটের কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

১২. ওয়াই-ফাই পোর্ট (Wi-Fi Port): ওয়াই-ফাই পোর্ট স্মার্টফোনে রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করে ওয়্যারলেস ইন্টারনেটে সংযোগ স্থাপন করে । ওয়াই-ফাই ব্যবহার করে ইন্টারনেটের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি হট স্পট প্রয়োজন হয়। তবে থ্রি জি সেলুলার নেটওয়ার্ক এর চেয়ে ফোর জি স্মার্টফোনগুলো দ্রুত ওয়্যারলেস বা ওয়াই-ফাই সংযোগ ব্যবহার করতে পারে।

১৩. স্পিকার (Speaker): স্পিকার ইলেকট্রিক্যাল (অডিও) সিগন্যালকে শ্রোতার শ্রবণযোগ্য শব্দ শক্তিতে রুপান্তর করে।

১৪. মাইক্রোফোন (Microphone): মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় মাইক্রোফোন শব্দ শক্তির সমতুল্য ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালে রুপান্তর করে।

১৫. ব্লুটুথ মডিউল (Bluetooth Module ) : ব্লুটুথ হচ্ছে তারবিহীন পার্সোনাল এরিয়া নেটওয়ার্ক প্রটোকল (Network Protocal) যা স্বল্প দূরত্বে ডাটা আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয়। মোবাইল ফোনে ব্লুটুথ বিল্ট ইন আকারে থাকে। ব্লুটুথের সাহায্যে এক ফোন হতে অন্য ফোনে ডাটা ট্রান্সফার করা যায়।

১৬. সিমকার্ড ইউনিট বা সিম কার্ড সকেট (SIM Card Unit or SIM Card Socket): সিম (SIM ) এর পূর্ণরূপ ‘সাবসক্রাইবার আইডেনটিফিকেশন মডিউল’ (Subscriber Identification Module) যার די বাংলা অর্থ ‘গ্রাহক পরিচিতি মডিউল’ । সিমকার্ডকে সিম সকেটের সাথে সংযুক্ত করা হয়।

১৭. জিপিআরএস/ জিএসএম মডেম (GPRS / GSM Modem) : জেনারেল প্যাকেট রেডিও সার্ভিসেস ( GPRS : General Packet Radio Services) ওয়্যারলেস এবং সেলুলার নেটওয়ার্ক যোগাযোগ পরিষেবাদির জন্য একটি সেরা প্রচেষ্টা প্যাকেট-সুইচিং প্রোটোকল। এটি সর্বোত্তম প্রচেষ্টা হিসাবে বিবেচিত হওয়ায় সমস্ত প্যাকেটকে একই সময়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

১৮. আরএক্স/টিএক্স সুইচ (Rx/Tx Switch): মোবাইল ফোন ট্রান্সমিটার (Tx – Transmitter) এবং রিসিভার ( Rx Receiveer) হিসাবে কাজ করে। যখন গ্রাহকের মোবাইল ফোন হতে ভয়েস বা ডাটা প্রেরণ করা হয় তখন মোবাইল ফোনের আরএক্স/টিএক্স সুইচ অটোমেটিক ট্রান্সমিটার মোডে অর্থাৎ টিএক্স সুইচ অন হয় এবং ভয়েস বা ডাটা প্রেরণ করা হয় এবং ডাটা রিসিভ করার সময় আরএক্স মোডে সুইচ অন করে ভয়েস বা ডাটা রিসিভ করা হয়।

১৯. জিপিএস (GPS): জিপিএস হলো গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (Global Positioning System)। এর দ্বারা স্যাটেলাইটের সাহায্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী নিজের বর্তমান লোকেশন জানতে পারে এবং অন্যান্য জিপিএস ব্যবহারকারীদের লোকেশন জানা যায় ।

২০. বাফার (Buffer): বাফার এক্সটেনশন কানেক্টরের ( Extension Connector) মাধ্যমে বাহ্যিক ডিভাইসকে প্রসেসরের সাথে সংযুক্ত করে। বাফার বাহ্যিক ডিভাইসের সিগন্যালকে প্রসেসরের ইনপুটের সমতুল্য সিগন্যালে রুপান্তর করে এবং সিগন্যালটিকে বিবর্ধন করে প্রসেসিং করার জন্য প্রসেসরে প্রেরণ করে। পরবর্তীতে প্রসেসরের সিগন্যালকে বিবর্ধন করে এক্সটেনশন কানেক্টরের মাধ্যমে বাহ্যিক ডিভাইসে প্রেরণ করে।

২১. ইউএসবি (USB): ইউএসবি এর পূর্ণরূপ ইউনিভার্সেল সিরিয়াল বাস (Universal Serial Bus মোবাইল ফোনে চার্জিং এবং ডাটা আদান প্রদানের জন্য মাইক্রো ইউএসবি পোর্ট ব্যবহার করা হয়। তবে টাইপ সি পোর্টও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

 

google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment