আজকের আলোচনার বিষয়: ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্টসমূহের ভৌত কাঠামো, প্রতীক, ফাংশন, প্রয়োগ ও স্পেসিফিকেশন। এই বিষয়টি জেনারেল ইলেকট্রনিক্স ১ কোর্সের “ইলেকট্রনিক কাজে ব্যবহৃত হ্যান্ড টুলস, পরিমাপক যন্ত্র এবং কম্পোনেন্টসমূহের ব্যবহার ও টেস্টিং” অংশের অন্তর্গত।
ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তিতে বিভিন্ন ধরণের কম্পোনেন্ট যেমন রেজিস্টর, ক্যাপাসিটার, ডায়োড, ট্রানজিস্টর ইত্যাদির সঠিক ব্যবহার ও বোঝাপড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কম্পোনেন্টের ভৌত কাঠামো, সার্কিটে ব্যবহৃত প্রতীক, তাদের কার্যকারিতা বা ফাংশন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগের ধরন এবং প্রযুক্তিগত স্পেসিফিকেশন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা অপরিহার্য।
আজকের পাঠে আমরা এসব ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্টের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা শিক্ষার্থী ও প্রযুক্তিবিদদের জন্য ইলেকট্রনিক সার্কিট ডিজাইন, মেরামত ও পরীক্ষায় দারুণ সহায়ক হবে।
Table of Contents
ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্ট সমূহের ভৌত কাঠামো, প্রতীক, ফাংশন, প্রয়োগ ও স্পেসিফিকেশন
এ অনুচ্ছেদে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্টের বাস্তবিক চিত্র, প্রতীক, উহাদের কাজ ও স্পেসিফিকেশন সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
রেজিস্টর (Resistor) :
রেজিস্টর হল বাধা অর্থাৎ যে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ইলেকট্রনের গতিপথে বাধা সৃষ্টি করলেও তাদের চলার পথকে বন্ধ করে না সেই ইলেকট্রনিক ডিভাইসকে রেজিস্টর বলা হয়। রেজিস্টর সার্কিটে কারেন্ট প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে এবং এর আড়াআড়িতে ভোল্টেজ ড্রপের সৃষ্টি হয়। রেজিস্টরের বাধাকে রেজিস্ট্যান্স বলে। রেজিস্ট্যান্স এর একক হল ওহম। রেজিস্টর কার্বন বা সিরামিক জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়। কার্বন রেজিস্টরে কার্বন জাতীয় পদার্থ এবং সিরামিক রেজিস্টরে সিরামিক জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা হয়। রেজিস্টরের দু’টি টার্মিনাল থাকে। সমস্ত রেজিস্টরের তিনটি প্রধান স্পেসিফিকেশন রয়েছে যা বিবেচনা করা হয়। সেগুলো হল:
১. রেজিস্টরের মান ১ ওহম থেকে মেগা ওহম পর্যন্ত
২. সহনশীলতা- টলারেন্স ১% থেকে ১০%
৩. পাওয়ার রেটিং- ০.২৫,০.৫,১,২,৫,২৫ ওয়াট
ক্যাপাসিটর (Capacitor) :
দু’টি সমান্তরাল পরিবাহীকে পরস্পর কোনো অপরিবাহী পদার্থ (Dielectric Material) দ্বারা পৃথক করা হলে তাকে ক্যাপাসিটর বলে। পোলারাইজ ক্যাপাসিটর চার্জ ধারণ করে এবং ভোল্টেজের পরিবর্তনকে বাধা প্রদান করে। ডিভাইসটির চার্জ ধারণ ক্ষমতা এর আকৃতি এবং ব্যবহৃত ভাই-ইলেকট্রিক মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল। ক্যাপাসিটরকে C প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। ক্যাপাসিটর তিন ধরণের হয়। ক) ইলেকট্রোলাইটিক ক্যাপাসিটর খ) সলিড-ডাই ইলেকট্রিক ক্যাপাসিটর এবং গ) পরিবর্তনশীল ক্যাপাস্টির।
ইন্ডাক্টর (Inductor):
ইন্ডাক্টর সার্কিটে কারেন্ট প্রবাহের হঠাৎ পরিবর্তনে বাধা প্রদান করে এবং সার্কিটে দু’টি উপাদানের মধ্যে কারেন্ট প্রবাহের সংযোগ পথ সৃষ্টি করে। ইন্ডাক্টরকে L প্রতীক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। ইন্ডাক্টরের দুটি টার্মিনাল থাকে। মোবাইল ফোনে এসএমডি ইন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয় এবং এর পারের কোড অনুযারী মান নির্ণয় করা হয়।
ডায়োড (Diode):
ডারোড একটি অর্থ পরিবাহী (সেমিকন্ডাক্টর) ডিভাইস। এটিকে সেমিকন্ডাক্টর ডায়োড বা পিএন জাংশন ডায়োড বলে। ডায়োড সিলিকন বা জার্মেনিয়াম সেমিকন্ডাক্টর দ্বারা তৈরি। একটি পি-টাইপ এবং একটি এন-টাইপ (P-Type and N – Type) সেমিকন্ডাক্টর পাশাপাশি স্থাপন করলে পিএন জাংশন ডায়োড (PN Junction Diode) সৃষ্টি হয়। এর পি-টাইপ টাইপ সেমিকন্ডারের সাথে যুক্ত টার্মিনালকে অ্যানোড (Anode) এবং এন-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরের সাথে যুক্ত টার্মিনালকে ক্যাথোড (Cathode) বলা হয়। ক্যাথোড প্রাঙ্কে সাদা দাগ থাকে । এটি একমূখী কারেন্ট প্রবাহ করে অর্থাৎ ফরোওয়ার্ড বায়াসে ( Forward Bias) কারেন্ট প্রবাহ হয় এবং এসিকে পালসেটিং ডিসিতে (Pulsating DC) রুপান্তর করে।
ট্রানজিস্টর (Transistor):
ট্রানজিস্টর দুর্বল সিগন্যালকে অল্পমানের রেজিস্ট্যান্স থেকে বেশি মানের রেজিস্ট্যান্সের দিকে স্থানান্তর করে অর্থাৎ দুর্বল সিগন্যালকে বিবর্ধন করে শক্তিশালি সিগন্যালে রুপান্তর করে। এটি মূলত অ্যামপ্লিফায়ার হিসেবে কাজ করে। ট্রানজিস্টর দু’টি পি-টাইপ এবং একটি এন- টাইপ সেমিকন্ডাক্টর বা দু’টি এন-টাইপ এবং একটি পি-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে গঠিত। তাই গঠন অনুযায়ী ট্রানজিস্টর দুই ধরণের হয়। যথা: পিএনপি এবং এনপিএন। ট্রানজিস্টরের তিনটি টার্মিনাল থাকে। যথা: বেস(Base), কালেক্টর (Collector) এবং ইমিটার(Emitter)।
ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC-Integrated Circuit):
ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট সংক্ষিপ্ত রুপকে আইসি বলা হয়। আইসি এমন এক ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস যা অসংখ্য রেজিস্টর, ডায়োড ও ট্রানজিস্টরের সমন্বয়ে তৈরি। আইসি আবিষ্কারের ফলে সার্কিট অনেক ছোট হয়ে গেছে।
লাইট-এমিটিং ডায়োড (Light Emitting Diode):
আলোক নিঃসারী ডায়োড বা ইংরেজিতে লাইট-এমিটিং ডায়োড বা সংক্ষেপে এলইডি (LED-Light Emitting Diode) নামে পরিচিত । ইলেকট্রনিক্স ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত এটি একটি অর্ধপরিবাহী ডায়োড। এলইডি এমন একটি অর্ধপরিবাহী কম্পোনেন্ট যা আলো বিকিরণ করে থাকে। ইহা এলইডি টিভি, বিভিন্ন ধরনের ডিসপ্লে তৈরি ও ইন্ডিকেটর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জিনার ডায়োড (Zener Diode):
জিনার ডায়োড হলো একটি বিশেষ ধরনের ডায়োড যা সাধারণ ডায়েডের মতো শুধুমাত্র ফরোয়ার্ড বায়সে কারেন্ট প্রবাহিত করে না, এটা রিভার্স বায়াসেও কারেন্ট প্রবাহিত করে। এ ডয়োড সাধারণ ডায়োডের চেয়ে বেশি মাত্রায় ডোপিং করা থাকে। এটি সবসময় সার্কিটের সাথে রিভার্স বায়াসে সংযুক্ত করতে হয় এবং ইহা ব্রেকডাউন ভোল্টেজেও নষ্ট হয় না। জিনার ডায়োড ভোল্টেজ রেগুল্টের ও ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার হিসেবে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়।
ফটো ডায়োড (Photo Diode):
ফটো ডায়োড হলো একটি আবরন যুক্ত ডায়োড যার উপর আলো পড়লে এর মধ্যে দিযে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এটা রিভার্স বায়সেও কাজ করে। এর বৈশিষ্ট্য হলো ডায়োডের উপর আলো পড়লে এর লিকেজ কারেন্টের পরিবর্তন হয় । ফটো ডায়োড হলো এলডিআর রেজিস্টর এর মত আলোতে কাজ করে এবং এর উপর কতটা আলো পড়বে তার উপর কারেন্টের পরিমাণ নির্ধারিত হয়।
মেটাল অক্সাইড সেমিকন্ডাক্টর ফিল্ড ইফেক্ট ট্রানজিস্টার (Metal Oxide Semiconductor Field Effect Transistor):
ইহাকে সংক্ষেপে মসফেট (MOSFET) বলে। মসফেট (MOSFET) একটি তিন টার্মিনাল বিশিষ্ট একটি বিশেষ ধরনের ফিল্ড ইফেক্ট ট্রানজিস্টর। টার্মিনাল তিনটি হল গেট, সোর্স এবং ড্রেন । মসফেট ব্যাপকভাবে সুইচিং ও অ্যাম্পিফিকেশনের কাজে ব্যবহৃত হয়। ইহার দুটি মোডে অপারেশন হয়ে থাকে। যথা: ডিপ্লেশন মোড ও এ্যান্সহ্যান মোড। ইহাকে অনেক সময় ইনসুলেটেড গেট এফইটি বা আইজিএফইটি বলা হয়। মসফেট দুই ধরনের যথাক্রমে এন-মসফেট (n-MOSFET) ও পি-মসফেট (p-MOSFET ) ।

ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্টসমূহের ভৌত কাঠামো, প্রতীক, ফাংশন, প্রয়োগ এবং স্পেসিফিকেশন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন ইলেকট্রনিক্স শিক্ষার্থীদের ও পেশাদারদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই জ্ঞান তাদের কম্পোনেন্ট সঠিকভাবে ব্যবহার, সার্কিট ডিজাইন, মেরামত এবং কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে সহায়তা করে। ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের বৈশিষ্ট্য ও কার্যক্ষমতা বুঝে তাদের কার্যকর প্রয়োগ সম্ভব হয়, যা প্রযুক্তির উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তাই ইলেকট্রনিক্স ক্ষেত্রে সুসংগঠিত এবং বিস্তৃত কম্পোনেন্ট জ্ঞানের বিকাশ আজকের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য অপরিহার্য।