আজকের আলোচনার বিষয় হলো পেশাগত নিরাপত্তা, যা ‘জেনারেল ইলেকট্রনিক্স-১’ পাঠ্যক্রমের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশের অন্তর্ভুক্ত। ইলেকট্রনিক্স পেশাজীবনে কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, কারণ এ পেশায় সরাসরি বিদ্যুৎ ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সংস্পর্শে কাজ করতে হয়, যার ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেশি।
এই পাঠে আমরা জানব কীভাবে নিরাপদে ও সচেতনভাবে ইলেকট্রনিক্স পেশায় কাজ করতে হয়, কী কী ঝুঁকি বিদ্যমান এবং কীভাবে সেগুলোর প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সুরক্ষা, যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নিয়ম, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, পরিবেশগত ঝুঁকি ইত্যাদি নিয়েও এখানে আলোচনা করা হবে।
একজন দক্ষ ও দায়িত্ববান ইলেকট্রনিক্স টেকনিশিয়ান হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হলে পেশাগত নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা অর্জন আবশ্যক। তাই চলুন, আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ পাঠে যুক্ত হই—পেশার নিরাপত্তায় সচেতন হই।
Table of Contents
পেশাগত নিরাপত্তা
যে কোনো প্রকার প্রতিকূল অবস্থাকে প্রতিরোধের মাধ্যমে নিরাপদে কাজ করাকে অকুপেশনাল সেফটি বা পেশাগত নিরাপত্তা বলে ।
পেশাগত নিরাপত্তা তিন প্রকার। যথা:
(১) ব্যক্তিগত নিরাপত্তা;
(২) যন্ত্রপাতি ও মেশিনের নিরাপত্তা
(৩) কারখানার নিরাপত্তা ।
ব্যক্তিগত নিরাপত্তা (Personal Safety):
দুর্ঘটনার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য যে সকল সাবধানতা মেনে চলা হয়, তাই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা । শিল্প-কারখানায় কর্মীগণ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করে থাকে।
ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম (PPE – Personal Protective Equipment):
কর্মস্থলে কার্যাবস্থায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি হতে কর্মীকে বাঁচানোর জন্য যে সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম ও পোষাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা হয়, সেগুলোকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম বা পিপিই (PPE) বলা হয় । একজন ব্যক্তির কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সম্ভাব্য ক্ষতি বা দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করার উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম (পিপিই) সমূহকে নিম্নলিখিত ভাবে ভাগ করা যায়-
চোখের সুরক্ষা (Eye Protective Equipment ):
চোখের বিপদের উৎসসমূহ- ছিটকে আসা রাসায়নিক পদার্থ বা ধাতব বস্তু, ধূলাবালি, ক্যাটালিস্ট পাউডার (Catalyst Powder), প্রোজেক্টাইল ( Projectile), গ্যাস ( Gas), বাষ্প (Steam) এবং রেডিয়েশন (Rediation) |
বিপদের উৎস:
রাসায়নিক ছিটকে আসা তরল
ধাতব কণা ও প্রোজেক্টাইল
ধুলাবালি
গ্যাস, বাষ্প
অতিবেগুনি রশ্মি বা রেডিয়েশন
চোখ সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত পিপিই- নিরাপদ চশমা, গগলস, ফেস শিল্ড (মুখের ঢাকনা) ইত্যাদি ।
সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত PPE:
সেফটি গগলস (Goggles)
নিরাপত্তা চশমা
ফেস শিল্ড (Face Shield)
কানের সুরক্ষা উপাদান (Ear Protective Element):
কানের বিপদের উৎস – শব্দের মাত্রা ৮৫ ডিবি এর অধিক হলে শব্দ দূষণ হয়। কানের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত পিপিই- ইরারপ্লাগ, ইয়ার মাস্ক, কান টুপি ইত্যাদি।
বিপদের উৎস:
উচ্চমাত্রার শব্দ (৮৫ ডেসিবেল বা তার বেশি)
সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত PPE:
ইয়ারপ্লাগ
ইয়ার মাস্ক
সাউন্ডপ্রুফ কান টুপি
মাথার জন্য সুরক্ষা উপাদান (Head Protective Element ):
মাথার বিপদের উৎসসমূহ- উপর থেকে কোনো বস্তু পড়লে, শক্ত বস্তুর আঘাত, ঘূর্ণায়মান বস্তুতে চুল পেঁচিয়ে যাওয়া ।
মাথার সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত পিপিই হেলমেট, মোটা বা স্ফীত টুপি।
বিপদের উৎস:
উপর থেকে বস্তু পড়ে যাওয়া
শক্ত বস্তুর আঘাত
ঘূর্ণায়মান যন্ত্রে চুল পেঁচিয়ে যাওয়া
সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত PPE:
হেলমেট
সুরক্ষা টুপি
শ্বাসযন্ত্রের সুরক্ষা উপাদান (Lungs Protective Element):
শ্বাসযন্ত্রের বিপদের উৎসসমূহ – ধুলাবালি, তাপ, অক্সিজেন এর ঘাটতি ইত্যাদি। শ্বাসযন্ত্রের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত পিপিই ফেস মাস্ক।
বিপদের উৎস:
ধুলাবালি ও ধোঁয়া
রাসায়নিক গ্যাস
অক্সিজেন স্বল্পতা
সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত PPE:
ফেস মাস্ক
রেসপিরেটর (বিশেষ ধরনের মাস্ক)
শরীরের জন্য সুরক্ষা উপাদান (Body Protective Element):
শরীরের বিপদের উৎসসমূহ – অতিরিক্ত তাপমাত্রা, খারাপ আবহাওয়া, ছিটকে আসা কোনো রাসায়নিক পদার্থ বা ধাতব খণ্ড, ভয়ানক গতিতে বায়ু প্রবাহ, সূঁচালো কোনো বন্ধ শরীরে ঢুকে পড়া এবং ধুলাবালি দ্বারা দূষণ । শরীর সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত পিপিই – বয়লার সুট, রাসায়নিক সুট, ভেস্ট (Vest), অ্যাঞ্জন, পুরো শরীর ঢাকা সুট, জ্যাকেট ইত্যাদি।
বিপদের উৎস:
উচ্চ তাপমাত্রা বা ঠাণ্ডা
ক্ষতিকর রাসায়নিক বা ধাতব কণা
ধুলাবালি ও বিষাক্ত গ্যাস
সূঁচালো বস্তু
সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত PPE:
বয়লার সুট
রাসায়নিক সুট
সুরক্ষা ভেস্ট
সম্পূর্ণ শরীর আবৃত জ্যাকেট বা ইউনিফর্ম
হাত এবং বাহু (আর্য) এর জন্য সুরক্ষা উপাদান (Hand and Arm Protective Element):
হাত এবং বাহর বিপদের উৎসসমূহ – অধিক তাপমাত্রা, সূঁচালো কোনো বস্তু, ভারী কোনো বস্তু, বৈদ্যুতিক শক, রাসায়নিক সংক্রামক পদার্থ ।
হাত এবং বাহুর সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত পিপিই – হাত মোজা (Hand Gloves ), আর্মলেটস (Ammlets) এবং মিটস্ (Mitts) ইত্যাদি।
বিপদের উৎস:
তাপ ও আগুন
সূঁচালো বা ধারালো বস্তু
বৈদ্যুতিক শক
রাসায়নিক পদার্থ
সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত PPE:
হ্যান্ড গ্লাভস (Hand Gloves)
আর্মলেটস (Armlets)
মিটস (Mitts)
পায়ের পাতার সুরক্ষা উপাদান (Foot Protective Element):
পায়ের পাতার বিপদের উৎসসমূহ পিচ্ছিল মেঝে, ভিজা মেঝে, ধারালো বস্তু, পড়ে থাকা বন্ধ, রাসায়নিক স্প্ল্যাশিং (Chemical Splashing) এবং অন্যান্য ভরল পদার্থ ইত্যাদি।
বিপদের উৎস:
পিচ্ছিল ও ভেজা মেঝে
ধারালো ও ভারী বস্তু
রাসায়নিক তরল ছিটকে পড়া
বৈদ্যুতিক শক
সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত PPE:
সুরক্ষা জুতো (Safety Shoes)
স্টিল টো বুট
লেপিনস (বিশেষ মোজা বা কাপড়ের আবরণ)
স্প্যাটস (পাতলা আবরণ)
পায়ের পাতার সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত পিপিই- সুরক্ষা ভূতা, সুরক্ষা বুট, লেপিনস্ মোজা (কাপড়ের তৈরি পায়ের আচ্ছাদন), স্প্যার্ট (পাতলা আচ্ছাদন) ইত্যাদি। সেটি সুজ বা নিরাপদ ঘুতা, ভারী ধাতব, উত্তপ্ত গলিত ধাতু, ধারালো বস্তুর আঘাত থেকে রক্ষা করে। এমনকি বৈদ্যুতিক শক্ থেকেও রক্ষা করে।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য PPE অপরিহার্য। এটি শুধু কর্মীর জীবন ও স্বাস্থ্য রক্ষা করে না, বরং দুর্ঘটনা হ্রাসের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা ও প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতাও বাড়িয়ে তোলে। তাই প্রত্যেক কর্মী ও নিয়োগকর্তার উচিত যথাযথভাবে PPE ব্যবহারের গুরুত্ব অনুধাবন করে তার বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

(২) যন্ত্রপাতি ও মেশিনের নিরাপত্তা (Machinery Safety):
এটি কারখানার যন্ত্র, মেশিন ও সরঞ্জামের নিরাপদ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত।
উদ্দেশ্য: যন্ত্রপাতির ভুল ব্যবহার বা যান্ত্রিক ত্রুটি যেন দুর্ঘটনা বা চোটের কারণ না হয়।
মূল দিকসমূহ:
নিয়মিত যন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ (Maintenance)
Overload, Short Circuit বা যান্ত্রিক ত্রুটি চিহ্নিত করা
Emergency shut-off সিস্টেম থাকা
অপারেটরদের যথাযথ প্রশিক্ষণ
মেশিনের চলন্ত অংশে গার্ড বা কভার লাগানো
উদাহরণ:
একটি লেদ মেশিনে ব্যবহারের সময় চুল পেঁচিয়ে যাওয়া ঠেকাতে গার্ড লাগানো ও নির্ধারিত পোশাক পরিধান করা।
(৩) কারখানার নিরাপত্তা (Workplace or Factory Safety):
পুরো কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—এটিই কারখানার নিরাপত্তার উদ্দেশ্য।
উদ্দেশ্য: কর্মস্থলে যেন সব কর্মী নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে পারেন এবং কোনো ধরনের পরিবেশগত ঝুঁকি না থাকে।
মূল দিকসমূহ:
যথাযথ আলোকসজ্জা ও বায়ু চলাচল
স্লিপ ও ট্রিপ প্রতিরোধে শুকনো ও পরিষ্কার মেঝে
অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র স্থাপন ও ফায়ার ড্রিল
রাসায়নিক পদার্থের সঠিক সংরক্ষণ
জরুরি নির্গমন পথ (Emergency Exit) নিশ্চিত করা
সাইনবোর্ড ও সতর্কতামূলক বার্তা ব্যবহার
উদাহরণ:
কারখানায় ফায়ার অ্যালার্ম ও ফায়ার এক্সটিংগুইশার স্থাপন এবং নিয়মিত মহড়া (drill) চালানো।
পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল কর্মীর অধিকারই নয়, বরং প্রতিষ্ঠান, যন্ত্র ও সমাজের কল্যাণের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, যন্ত্রপাতি এবং কারখানার নিরাপত্তা—এই তিনটি দিক একত্রে কর্মক্ষেত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে, যা দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি হ্রাস করে এবং কর্মীদের উৎসাহ ও মনোবল বাড়িয়ে তোলে।