আজকের আলোচনার বিষয়: মোবাইল ফোনের বিভিন্ন কম্পোনেন্টসমূহের ভৌত কাঠামো, প্রতীক, ফাংশন এবং সঠিক ব্যবহার পদ্ধতি। এই পাঠটি জেনারেল ইলেকট্রনিক্স ২ কোর্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন সার্ভিসিং ও মেরামতে প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করবে। এখানে মোবাইল ফোনের প্রতিটি কম্পোনেন্টের গঠন, বৈশিষ্ট্য, তাদের প্রতীক এবং কম্পোনেন্টগুলোর কার্যকারিতা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি, প্রতিটি অংশের সঠিক ব্যবহার পদ্ধতি ও পরীক্ষণ কৌশল তুলে ধরা হবে, যা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। এটি মোবাইল ফোনের হার্ডওয়্যার বুঝতে এবং মেরামতের কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করতে একটি মজবুত ভিত্তি স্থাপন করবে।
Table of Contents
মোবাইল ফোনের কম্পোনেন্ট সমূহের ভৌত কাঠামো, প্রতীক, ফাংশন এবং ব্যবহার পদ্ধতি (Physical Structure, Symbol, Function, Application and Specification of Different Components Uses in Mobile)
নিম্নে মোবাইল ফোনের কম্পোনেন্টসমূহের ভৌত কাঠামো, প্রতীক, ফাংশন এবং ব্যবহার পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো:
রেজিস্টর (Resistor):
রেজিস্টর হলো এমন একটি ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্ট যা ইলেকট্রনের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে, তবে সম্পূর্ণভাবে তার চলাচল বন্ধ করে না। সহজভাবে বলা যায়, রেজিস্টর এমন একটি যন্ত্রাংশ যা সার্কিটে বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তার গতিপথে প্রতিরোধ বা বাধা তৈরি করে। এই বাধাকেই রেজিস্ট্যান্স (Resistance) বলা হয় এবং এর পরিমাপের একক হলো ওহম (Ω)।
রেজিস্টর কারেন্টের প্রবাহে নির্দিষ্ট পরিমাণ বাধা প্রদান করে, যার ফলে রেজিস্টরের দুই প্রান্তে ভোল্টেজ ড্রপ (Voltage Drop) সৃষ্টি হয়। এটি সার্কিটের অন্যান্য উপাদানের সুরক্ষা ও কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। সাধারণত রেজিস্টর কার্বন, সিরামিক বা ধাতব ফিল্ম জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়। কার্বন রেজিস্টর কার্বন পদার্থ দিয়ে এবং সিরামিক রেজিস্টর সিরামিক পদার্থ দিয়ে গঠিত হয়।
রেজিস্টরের দুটি টার্মিনাল থাকে, যার মাধ্যমে এটি সার্কিটে সংযুক্ত হয়। মোবাইল ফোন ও অন্যান্য আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইসে সাধারণত এসএমডি (SMD: Surface Mount Device) রেজিস্টর ব্যবহৃত হয়, যেগুলো ছোট এবং মাদারবোর্ডের উপর সরাসরি মাউন্ট করা হয়। এসএমডি রেজিস্টরের মান প্রকাশের জন্য প্রচলিত রঙিন ব্যান্ডের পরিবর্তে বিশেষ কোড বা নম্বর ব্যবহৃত হয়।
ক্যাপাসিটর (Capacitor):
ক্যাপাসিটর হলো একটি ইলেকট্রনিক উপাদান যা দুটি সমান্তরাল পরিবাহী প্লেটের মাধ্যমে গঠিত, যাদের মধ্যে একটি অপরিবাহী পদার্থ (Dielectric Material) দ্বারা পৃথক করা থাকে। এটি বৈদ্যুতিক চার্জ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার ক্ষমতা রাখে এবং ভোল্টেজের পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে, পোলারাইজড ক্যাপাসিটর (Polarized Capacitor) চার্জ ধারণ করে এবং হঠাৎ ভোল্টেজ পরিবর্তনকে বাধা দেয়।
ক্যাপাসিটরের চার্জ ধারণ ক্ষমতা বা ক্যাপাসিট্যান্স (Capacitance) নির্ভর করে এর ভৌত আকার, প্লেটের এলাকা এবং ব্যবহৃত ডাই-ইলেকট্রিক পদার্থের ধরন ও গুণগত মানের উপর। ইলেকট্রনিক সার্কিটে ক্যাপাসিটরকে সাধারনত ‘C’ প্রতীক দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
ক্যাপাসিটর প্রধানত তিন প্রকারের হয়:
ক) ইলেকট্রোলাইটিক ক্যাপাসিটর (Electrolytic Capacitor),
খ) সলিড ডাই-ইলেকট্রিক ক্যাপাসিটর (Solid Dielectric Capacitor),
গ) পরিবর্তনশীল ক্যাপাসিটর (Variable Capacitor)।
মোবাইল ফোনের সার্কিটে সাধারণত এসএমডি (Surface Mount Device) ক্যাপাসিটর ব্যবহৃত হয়, যা ছোট আকারের ও উচ্চ কার্যক্ষমতার জন্য পরিচিত। এসএমডি ক্যাপাসিটরের মান রেজিস্টরের মতোই পায়ে লিপিবদ্ধ বিশেষ কোডের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়, যা সহজেই পড়া ও বোঝা যায়।
ইন্ডাক্টর (Inductor):
ইন্ডাক্টর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রনিক উপাদান, যা সার্কিটে কারেন্টের হঠাৎ পরিবর্তনকে বাধা দেয় এবং কারেন্ট প্রবাহের মসৃণতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি মূলত একটি তারের কয়েল, যা বৈদ্যুতিক চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে কারেন্টের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। ইন্ডাক্টরকে সাধারণত প্রতীক হিসাবে ‘L’ দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এবং এতে দুইটি টার্মিনাল থাকে।
মোবাইল ফোনের সার্কিটে সাধারণত এসএমডি (Surface Mount Device) ইন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয়, যা ছোট আকারের এবং সার্কিট বোর্ডে সহজেই সংযুক্ত করা যায়। ইন্ডাক্টরের মান তার কয়েল গায়ের ঘনত্ব ও আকারের ওপর নির্ভর করে এবং তা গায়ের উপর ছাপানো নম্বর বা কোডের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। মোবাইল ফোনের বিভিন্ন ডিভাইসে ইন্ডাক্টর সিগন্যাল ফিল্টারিং, পাওয়ার সাপ্লাই ম্যানেজমেন্ট এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ডায়োড (Diode):
ডায়োড একটি অর্ধপরিবাহী ডিভাইস (Semiconductor Device), যাকে সেমিকন্ডাক্টর ডায়োড বা পি-এন জাংশন ডায়োড (PN Junction Diode) বলা হয়। এটি সাধারণত সিলিকন বা জার্মেনিয়াম ভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর উপকরণ থেকে তৈরি হয়। ডায়োডে দুটি অংশ থাকে — একটি পি-টাইপ (P-Type) এবং একটি এন-টাইপ (N-Type) সেমিকন্ডাক্টর — যাদের সংযোগ থেকে পি-এন জাংশন গঠিত হয়।
ডায়োডের দুটি টার্মিনাল থাকে: পি-টাইপ অংশের সঙ্গে যুক্ত টার্মিনালকে অ্যানোড (Anode) এবং এন-টাইপ অংশের সঙ্গে যুক্ত টার্মিনালকে ক্যাথোড (Cathode) বলা হয়। ক্যাথোডের পাশে সাধারণত একটি সাদা বা কালো দাগ থাকে যা তাকে চিহ্নিত করে।
ডায়োডের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি একমুখীভাবে কারেন্ট প্রবাহের অনুমতি দেয়। অর্থাৎ, যখন ডায়োড ফরোয়ার্ড বায়াস (Forward Bias) থাকে, তখন এটি বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে; আর বিপরীত বায়াস (Reverse Bias) এ এটি কারেন্ট প্রবাহ বন্ধ করে রাখে। এই বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে ডায়োড এসি সংকেতকে পালসেটিং ডিসি (Pulsating DC) তে রূপান্তর করতে সক্ষম।
মোবাইল ফোনে সাধারণত ছোট সাইজের এসএমডি (Surface Mount Device) ডায়োড ব্যবহার করা হয়, যা একমুখী কারেন্ট প্রবাহ নিশ্চিত করে এবং ডিভাইসের কার্যকারিতা বজায় রাখতে সহায়ক।

ট্রানজিস্টর (Transistor):
ট্রানজিস্টর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সেমিকন্ডাক্টর উপাদান, যা দুর্বল ইলেকট্রিক সিগন্যালকে শক্তিশালী করে উচ্চমানের সিগন্যাল হিসেবে রূপান্তরিত করে। অর্থাৎ, এটি মূলত একটি অ্যাম্প্লিফায়ার (Amplifier) হিসেবে কাজ করে। এছাড়া, ট্রানজিস্টর সিগন্যালের সুইচিং এবং নিয়ন্ত্রণেও ব্যবহৃত হয়।
ট্রানজিস্টর দুটি পি-টাইপ এবং একটি এন-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর অথবা দুটি এন-টাইপ এবং একটি পি-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর উপাদান নিয়ে গঠিত হয়। গঠনের ভেদে ট্রানজিস্টর দুই ধরনের হয়ে থাকে: পিএনপি (PNP) এবং এনপিএন (NPN)।
ট্রানজিস্টরের তিনটি প্রধান টার্মিনাল থাকে, যথা:
বেস (Base)
কালেক্টর (Collector)
ইমিটার (Emitter)
বেস অংশটি ইমিটার এর তুলনায় অধিক ডোপিং করা থাকে, যার ফলে এটি ছোট পরিমাণ কারেন্ট নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। কালেক্টর অংশে রেজিস্ট্যান্স বেশি থাকে যা বৃহৎ পরিমাণ কারেন্ট প্রবাহের জন্য উপযোগী। ট্রানজিস্টরের এই বৈশিষ্ট্যগুলো সিগন্যালকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রবর্ধিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
ট্রানজিস্টর আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসে।
ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC: Integrated Circuit):
ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, সংক্ষেপে আইসি (IC) নামে পরিচিত, একটি অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস যা অসংখ্য ছোটখাটো রেজিস্টর, ক্যাপাসিটর, ডায়োড এবং ট্রানজিস্টরকে একত্রিত করে তৈরি হয়। আইসি প্রযুক্তির আবিষ্কারের ফলে ইলেকট্রনিক সার্কিটের আকার ব্যাপকভাবে ছোট হয়ে গেছে, যা মোবাইল ফোনসহ নানা আধুনিক যন্ত্রপাতির ক্ষুদ্র ও বহুমুখী কার্যক্ষমতার অন্যতম কারণ। মোবাইল ফোনের বিভিন্ন সেকশনে আইসি ব্যবহারের মাধ্যমে সার্কিটের জটিলতা কমিয়ে স্থাপত্য আরও কার্যকর এবং কম স্থানগ্রাহী করা সম্ভব হয়েছে।
ফিউজ (Fuse):
ফিউজ হলো একটি নিরাপত্তা উপাদান, যা সার্কিটে অতিরিক্ত কারেন্ট প্রবাহ থেকে রক্ষা করে। এটি একটি সংবেদনশীল কন্ডাক্টিভ উপাদান, যা সাধারণত সিরামিক বা গ্লাসের মধ্যে অবস্থান করে এবং দুই প্রান্তে পরিবাহী পদার্থ দ্বারা সংযুক্ত থাকে। মোবাইল ফোনে শর্ট সার্কিট বা অতিরিক্ত কারেন্ট প্রবাহ ঘটলে ফিউজ গলিয়ে সার্কিটকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং আগুন লাগা বা অন্যান্য বিপদ এড়ায়।
স্পিকার (Speaker):
মোবাইল ফোনে অডিও সিগন্যালকে বাস্তব শব্দে রূপান্তর করার জন্য স্পিকার ব্যবহৃত হয়। স্পিকারের প্রধান উপাদানসমূহ হলো ভয়েস কয়েল, স্থায়ী চুম্বক, কার্বন গুড়ো, ডায়াফ্রাম এবং স্পাইডার। যখন ভয়েস কয়েলে বৈদ্যুতিক সিগন্যাল প্রবাহিত হয়, তখন এটি চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে যা ডায়াফ্রামকে কম্পিত করে বাস্তব শব্দ সৃষ্টি করে। মোবাইলে বিভিন্ন আকার ও ক্ষমতার স্পিকার ব্যবহার করা হয়, যা সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট শব্দ প্রদান করে।
মাইক্রোফোন (Microphone):
মোবাইল ফোনে কথোপকথনের সময় শব্দ শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করার জন্য মাইক্রোফোন ব্যবহৃত হয়। সাধারণত ক্যাপাসিটিভ মাইক্রোফোন ব্যবহার করা হয়, যা শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে ক্যাপাসিটরের ধারণক্ষমতার পরিবর্তন ঘটিয়ে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল তৈরি করে। এর মাধ্যমে ফোনের মাইক্রোফোন শব্দকে স্পষ্টভাবে সংগ্রহ করে এবং তা সিগন্যাল হিসেবে প্রেরণ করে।
ভাইব্রেটর (Vibrator):
মোবাইল ফোনে কলিং বা মেসেজ আসার সময় রিংটোনের পাশাপাশি ব্যবহারকারীকে সতর্ক করার জন্য ভাইব্রেশন মোড ব্যবহৃত হয়। এই ভাইব্রেশন সৃষ্টির জন্য বিশেষ ভাইব্রেটর ব্যবহার করা হয়, যা ফোনকে স্পন্দিত করে আনুষ্ঠানিক সতর্কতা প্রদান করে, বিশেষ করে যখন ফোন নীরব মোডে থাকে।
এলসিডি (LCD):
মোবাইল ফোনে ডাটা, ছবি ও ভিডিও প্রদর্শনের জন্য লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লে (LCD) ব্যবহৃত হয়। ফিচার ফোনগুলোতে সাধারণত TFT এলসিডি ডিসপ্লে ব্যবহৃত হয়, যেখানে স্মার্টফোনগুলোতে উন্নত প্রযুক্তির আইপিএস, এইচডি, ফুল এইচডি, ফুল এইচডি প্লাস, রেটিনা ইত্যাদি রকমের ডিসপ্লে ব্যবহৃত হয়। এগুলো উচ্চ রেজোলিউশন ও প্রাণবন্ত রঙ প্রদানের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর দৃষ্টিতে মনোরম অভিজ্ঞতা তৈরি করে।